ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শোনা তো দূরের কথা, স্কুল-কলেজ পেরিয়েও যে শিক্ষা
নেওয়া যায়, সেটাই জানা ছিল না আবদুল খালেকের। ভাবতেন, ইশকুল-টিশকুল
পর্যন্তই বুঝি পড়ে সবাই। নিত্য অভাব লেগে থাকা যে পরিবারে বেড়ে ওঠা,
সেখানে নিজের নাম সই করতে পারাটাই যথেষ্ট বলেই বিবেচিত। খুব বেশি হলে
হাইস্কুলে দু-চার দিন ঘোরাঘুরি করো। তত দিনে সংসারের জোয়াল নেমে আসবে
তোমার কাঁধে। যে বয়সে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কিশোরেরা স্কুলে যায়, সেই
বয়সে খালেকদের মতো পরিবারের শিশুদের নেমে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে।
কলমের বদলে হাতে শক্ত করে ধরতে হয় কোদাল।খালেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম
প্রথম শোনেন ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। একজনের বাসায় গিয়ে দেখেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি গাইড। সেখান থেকেই প্রথম জানতে পারেন, প্রাচ্যের
অক্সফোর্ড নামে খ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। অবাক করা গল্পটা হলো, এত
পরে এসে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জীবনে প্রথমবারের মতো শুনেছিলেন, সেই ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হিসেবে এ বছর যোগ দিয়েছেন খালেক! উন্নয়ন
অধ্যয়ন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে।
কীভাবে সম্ভব? অদম্য অধ্যবসায়, একাগ্রতা আর নিষ্ঠাই তাঁর পাথেয়!
খালেক নামের এই তরুণ শিক্ষকের জীবনের
গল্পটা অবিশ্বাস্য এক উত্থানের। জন্মেছেন বগুড়ার শাজাহানপুরের খলিশাকান্দি
গ্রামে। এমন একটা পরিবারে, যে পরিবারে শুধু অভাবেরই প্রাচুর্য ছিল। নুন
আনতে পান্তা ফুরোনো দূরে থাক খালেকদের পরিবারে দুটোই যে বাড়ন্ত।
ঘরের চাল কিংবা বাঁশের বেড়ার ভাঙা ফুটো
দিয়ে আকাশ দেখে দেখে বেড়ে উঠেছেন। আর তাই হয়তো আকাশ ছোঁয়ার দুঃসাহস
দেখাতে পেরেছেন। ‘পড়ালেখা করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’—এই আপ্তবাক্য সেই
শৈশবে মগজের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। পড়ালেখার মহত্ উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন
হতে পারে; তবে কারও কারও কাছে সেটা জীবনের টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বনও
হয়ে যায়। সেই শৈশবেই খালেক বুঝতে পেরেছিলেন, জীবনের টিকে থাকার এই
নিরন্তর সংগ্রামে একটাই অস্ত্র আছে তাঁর—পড়াশোনা!
যে পরিবারে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেখানে
পড়াশোনা ব্যাপারটাই ছিল বিলাসিতা। খালেক একটা গল্প শোনালেন, ‘তখন ক্লাস
থ্রি থেকে ফোরে উঠব। ফোরে ভর্তি হতে গেলে পাঁচ টাকা লাগে। বাড়িতে টাকা
চাইলাম। বাড়ির তখন যা অবস্থা, তাতে আমার ফোরে ভর্তি হওয়ার চেয়ে পাঁচ
টাকার গুরুত্ব অনেক। বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হলো, দরকার নাই ফোরে পড়ার। তুই
আবার থ্রিতেই ভর্তি হ।’
না, খালেকের শেষ পর্যন্ত কিছুই আটকায়নি।
পড়াশোনায় তাঁর হাতেখড়িই হয়েছে বাড়ির পাশের বিত্তবান এক পরিবারের
ছেলেমেয়েদের পড়ার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে শুনতে শুনতে। সেই বাড়ির
ছেলেমেয়েরা সুর করে পড়ত। আর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খালেক শুনে শুনে
মুখস্থ করতেন অ-আ-ক-খ। এ-বি-সি-ডি।
সেই শিক্ষা সম্বল করে ভর্তি হয়েছেন
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেই স্কুলের ইতিহাসে যেটা হয়নি, সেটাই তিনি
করে দেখিয়েছেন। পঞ্চম শ্রেণীতে পেয়েছিলেন বৃত্তি!
খালেকের জীবন থেকে প্রেরণার রাশি রাশি
গল্প আমরা মুঠো ভরে নিতে পারি। তেমনি একটা গল্প শোনালেন তিনি, ‘একবার বাড়ি
থেকে মেরে আমাকে বের করে দিয়েছে। পরনে শুধুই একটা হাফপ্যান্ট। খালি গা।
কী করি, কোথায় যাই। মনটা পড়ে আছে স্কুলে। স্কুলে না গেলে যে আমার ভালো
লাগে না। কী বুঝে ওই খালি গা, হাফপ্যান্ট নিয়েই স্কুলে গেলাম। কিন্তু
এভাবে কী করে স্কুলে ঢুকি? ক্লাসের বাইরে তাই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ইংরেজি
ক্লাস চলছিল। স্যার কী যেন একটা প্রশ্ন করলেন, কেউ উত্তর দিতে পারল না। আমি
মুখ ফসকে উত্তরটা দিয়ে দিলাম। তখন স্যারের খেয়াল হলো আমি বাইরে এভাবে
দাঁড়িয়ে আছি। একজন আমাকে একটা শার্ট এনে দিল। সেটা পরেই ক্লাসে ঢুকলাম।’
শুধু ক্লাস ফাইভে বৃত্তি নয়, চাঁচাইতারা
মাদলা যুক্ত উচ্চবিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম ছাত্র হিসেবে এসএসসিতে মানবিক
বিভাগ থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন রাজশাহী বোর্ড থেকে। ২০০১ সালে
বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসিতে অধিকার করেছিলেন তৃতীয়
স্থান। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায়
হয়েছিলেন ৩৬তম।
জীবনে উঠে আসার এই সংগ্রামে দেবতার মতো
তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অনেকেই। অনেকে পড়ার জন্য অর্থসাহায্য
করেছেন। কেউ পরার জন্য দিয়ে দিয়েছে নিজের পরনের শার্ট। তাঁদের মধ্যে
আনিসুর রহমান নামের একজনের কথা খালেক আজও ভুলতে পারেন না। পড়াশোনার প্রতি
এই অভাবী ছেলেটার অসীম আগ্রহ দেখে সেই ছোটবেলা থেকে কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা
দেখিয়ে দিয়েছেন আনিসুর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পথও
দেখিয়েছেন তিনি। ঢাকায় আসার পর অপছাত্ররাজনীতির আগুন থেকে বাঁচতে হলেই আর
ওঠেননি। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নূর মোহাম্মদ
তালুকদারের শ্যামলীর বাসায় থেকে পড়াশোনা করেছেন।
এইএসসিতে মেধাতালিকায় স্থান করে নেওয়ার
পর পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ দেখে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর
অফিসেও ডেকে নিয়েছিলেন খালেককে। দিয়েছিলেন ৫০ হাজার টাকা। বগুড়ার তখনকার
জেলা প্রশাসক শামসুল হকও সাহায্য করেছেন নিয়মিত। এইচএসসি পাসের পর প্রথম
আলো থেকেও নিয়মিত পেয়েছেন ভাতা।
সাহায্য অনেক মানুষের পেয়েছেন। সেই
তালিকাটা দীর্ঘ। তবে এটাও ঠিক, শুধু অন্যের সাহায্য পেলেই তো আর এগোনো যায়
না। পথচলাটা নিজের পায়ে ভর দিয়েই করতে হয়। অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম
শ্রেণীর সুবাদে আজ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
জীবন নিয়ে আমাদের অভিযোগের শেষ নেই।
না-পাওয়ার হাহাকার আমাদের যেকোনো প্রাপ্তিকে এক ফুঁত্কারে উড়িয়ে দেয়।
জীবনকে তাই আমরা প্রতিনিয়ত শাপশাপান্ত করে চলি। কিন্তু খালেকের মতো,
খালেকদের মতো কেউ কেউ আছেন, যাঁরা জীবনটাকেই চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস দেখান।
প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন—প্রতিদ্বন্দ্বী, এসো যুদ্ধ হবে!
সূত্র: প্রথম আলো
success story gula ashadharon laga
ReplyDelete